AI কি আমাদের সবার চাকরী খেয়ে দিবে?
সাম্প্রতিক সময়ে ChatGPT, DALL-E-2 এর মত বেশ কিছু AI টুলসের অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ সরগরম। সবার মুখে মুখে এখন AI নিয়ে কথা। AI এর সাফল্যে অনেকেই যেমন চমৎকৃত, একইসাথে সবার মনে একটা শঙ্কাও উঁকি দিচ্ছে। AI কি আমাদের চাকরী-বাকরী দখল করে নিবে? আমরা কি তাহলে খুব বড় ধরনের কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছি?
এই মুহুর্তে এ ব্যাপারে বাজারে দুটো মত বেশি প্রচলিতঃ
- AI খুব শীঘ্রই জব মার্কেটের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে নিবে এবং এটা আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
- AI নিয়ে এত শঙ্কার কিছু নেই। AI যদি কিছু জব দখলও করে, আরো অনেক জব তৈরিও করবে। সুতরাং এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
আমরা একটু প্র্যাক্টিক্যালি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করি।
তাঁর আগে কয়েকটা বিষয় একটু বলে নেয়া ভালো।
- মাত্র কয়েক বছর আগেও সবাই মনে করতো AI নিয়ে কাজকর্ম এখনো বেশ প্রাথমিক পর্যায়ে এবং এই সেক্টরে খুব কার্যকর কোনো সাফল্য দেখতে হলেও অন্তত আরো ৫-১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আসলেই কি আমাদের অত সময় অপেক্ষা করা লেগেছে? তারমানে কি আমাদের ধারণার চাইতেও অনেক দ্রুত গতিতে AI এর ইম্প্রুভমেন্ট হচ্ছে
- Buzzfeed নামে বেশ পপুলার একটা নিউজ এবং এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়া কোম্পানি সম্প্রতি তাদের কোম্পানির প্রায় ১২% এমপ্লয়ী ছাঁটাই করেছে এবং ঘোষণা দিয়েছে এদের পরিবর্তে তারা ChatGPT কে কাজে লাগাবে। এই ঘোষণার সাথে সাথেই মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের কোম্পানির শেয়ারের প্রাইস বেড়েছে প্রায় ৩০০% এরও বেশী। খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য নিউজ মিডিয়া এবং একইধারার প্রতিষ্ঠানগুলোও একইরকম চিন্তা ভাবনাই করবে, তাই না?
- Microsoft সম্প্রতি প্রায় ১০,০০০+ এমপ্লয়ী ছাঁটাই করেছে ইকোনমিক ক্রাইসিস সামনে আসছে এই ভয়ে। অথচ তাঁর কিছুদিন আগেই তারা OpenAI তে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত AI এর সাফল্যগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটা যদি আমরা দেখিঃ
- এখন এই মুহুর্তে Content writing বা লেখালেখির কাজ অনেক খানিই করা যাচ্ছে AI টুলগুলো দিয়ে। যার ফলে কন্টেন্ট রাইটিং যাদের পেশা তারা ইতোমধ্যে চাকরী হারাতে শুরু করেছেন
- মানুষ একসময় মনে করতো কবিতা লেখা, ছবি আঁকার মত শৈল্পিক কাজ করা AI এর কম্ম না। অলরেডি তাদের এই ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। একইসাথে গ্রাফিক্স ডিজাইন বা ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট নিয়েও অনেক এডভান্স কাজ এখনই করা যাচ্ছে AI টুলগুলো দিয়ে।
- গেইম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন এরকম অনেকেই জানেন এখন বিভিন্ন গেমের গ্রাফিক্সের কাজ, ক্যারেক্টার ডিজাইন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই AI টুল দিয়ে রিপ্লেস হওয়া শুরু হয়েছে। সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রেও তাই।
- Self-driving বা Driverless কারের পেছনে অনেক কোম্পানির বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট তাদেরকে সাফল্যের প্রায় দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। তাদের এই সাফল্যের ফলস্বরূপ ড্রাইভাররা তাদের চাকরী হারাতে শুরু করবে না?
- চীনে ইতোমধ্যে টিভিতে নিউজ প্রেজেন্টারের কাজ AI টুল দিয়ে করানোর এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়েছে, যেখানে স্ক্রিনে আমরা সত্যিকার কোনো নিউজ প্রেজেন্টার না বরং AI দিয়ে তৈরি করা কোনো একটা 3D মানুষের মডেলকে দেখবো যেটা হুবহু একজন সত্যিকার মানুষের মত।
এরকম আরো অনেক অনেক এক্সাম্পল দেয়া যাবে। প্রতিটা এক্সাম্পল থেকে কি বোঝা যাচ্ছে না যে সেটা রিলেটেড কোনো একটা সেক্টরের মানুষজনের জব হারানোর ক্ষেত্র তৈরি করছে? তারমানে এই রকম কতগুলো সেক্টরের কত মানুষের জব এফেক্টেড হবে সেটা কি বোঝা যাচ্ছে?
মনে হতে পারে, অন্যান্য সেক্টরে যেখানে গতানুগতিক কাজই বেশী সেখানে AI এর কারণে জব হারানো লাগতেই পারে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত মাথা খাটানোর কাজে এত সহজে AI কিছু করতে পারবে না। আসলেই কি তাই?
একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, কোডিং এর সব কাজই যে খুব ইউনিক বা অনেক মাথা খাটানোর, এমন না। অলরেডি No-code বা Low-code টুলগুলো অনেক জনপ্রিয় যেখানে কোডিং না জেনেও মানুষজন ওয়েবসাইট, ওয়েব এপ্লিকেশন, মোবাইল এপ্লিকেশন ইত্যাদি বানাতে পারছে। সেখানে AI যদি যুক্ত হয় তাহলে তো আরো সহজ হয়ে যাবে। আবার Kubernetes বা এরকম টুলগুলো এপ্লিকেশন ডেপ্লয়মেন্ট, স্কেলিং এর অনেক কিছুই অটোমেশনের মাধ্যমে সহজ করে দিয়েছে। এখানেও যদি AI যুক্ত হয় তাহলে ভবিষ্যতে একটা কোম্পানিতে SRE বা DevOps এর মত রোলে কি খুব বেশী মানুষজন লাগবে?
এই লেখা যখন লিখছি তখনই একটা নিউজ চোখে পড়লো। OpenAI (যারা ChatGPT, DALL-E-2 এর ক্রিয়েটর) ইতোমধ্যে ১০০০ এর বেশী লোক নিয়োগ দিয়েছে Data labelling এবং AI মডেল ট্রেইনিং এর জন্য যেখানে মূল টার্গেট হবে শীঘ্রই কোডিং রিলেটেড কাজগুলো যেন AI এর মাধ্যমে করানো সম্ভব হয়।
AI এর কারণে অনেক জব বিলুপ্ত হলেও আরো অনেক জবের ক্ষেত্র তৈরি হবে?
কথাটা একাংশে ঠিক। যেমন নতুন নতুন AI টুল বানানোর জন্য কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করবে। AI কে কিভাবে আরও ইম্প্রুভ করা যায় সেজন্য রিসার্চার দরকার পড়বে আরো। কিন্তু একইসাথে এটাও ঠিক, AI এর কারণে এক লাখ মানুষ জব হারালে আরো নতুন এক লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। কারণ মাঠে কামলা দেয়া ১০ জন মানুষের কাজ যখন একটা ট্রাক্টর বা মেশিন দিয়ে করা সম্ভব হয়েছে, তখন ১০ জন মানুষের চাকরী হারানোর বিপরীতে নতুন ১-২ জন মেশিন অপারেটরের চাকরী হয়েছে। একই কথা এই ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ এখানে লক্ষ্যই থাকবে অতিরিক্ত মানুষজন নিয়োগ দিয়ে কোম্পানিগুলোতে যাতে ‘লস’ না হয়।
বড় বড় কর্পোরেশন, টেক জায়ান্ট সবারই দিনশেষে লক্ষ্য ‘প্রফিট করা’। এ কারণে তারা যদি একজন এমপ্লয়ীকেও না রেখে তাদের কোম্পানির প্রফিট নিশ্চিত করতে পারে তাহলে তারা তাই করবে। প্রতিটা কোম্পানির ইনভেস্টররাও দিনশেষে চায় প্রফিট। কোম্পানিতে এমপ্লয়ী না রেখে, খরচ কমিয়ে তারা যদি AI টুল দিয়ে কাজ সারতে পারে তাহলে তারা সেটা করার জন্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ক্যাপিটালিস্টিক সিস্টেমে বিজনেসে ‘এথিকস’, ‘হিউম্যানিটি’ এর কোনো মূল্য নেই, রেভিনিউই সব।
তাহলে সামনে কি কেবলই অন্ধকার?
বর্তমান সময়ের অন্যতম ইনফ্লুয়েন্সার, Thought leader এবং বেশ কয়েকটি বেস্ট সেলিং বইয়ের লেখক Simon sinek কয়েকদিন আগে তাঁর পাবলিশ করা একটা ভিডিওতে বলছিলো,
‘Future of work’ নিয়ে এখন অনেকেই অনেক রকম মত এবং ভবিষ্যৎবাণী দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটা সম্পর্কে কারোই কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। যারা ‘প্রায় নিশ্চিত’ভাবে ভবিষ্যৎবাণী দিচ্ছে তাদেরও না। তারা কেবল আন্দাজের ভিত্তিতে কথা বলছে।
AI এর ব্যাপারটাও আসলে তাই। এই মুহূর্তে কারো পক্ষেই একেবারে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না আসলে AI আমাদের জব সেক্টরে ঠিক কতটুকু প্রভাব ফেলবে বা এটার মাধ্যমে আমরা সবাই কতটুকু ইম্প্যাক্টেড হবো। অথবা এটা আমাদের জন্য নতুন কোন কোন জবের ক্ষেত্রে তৈরি করবে।
তবে কেবলমাত্র মোটিভেশন দেয়ার জন্য ‘AI নিয়ে চিন্তার কিছু নেই’ বলাটা যে পুরোপুরি বাস্তবতাবিবর্জিত, এটা বলাই যায়। AI নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে, এটার কারণে সামনে জব সেক্টরে কোথায় কি ধরনের পরিবর্তন আসছে, কিভাবে নিজেকে সেই চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত রাখা যায় এগুলো অবশ্যই অবশ্যই ভাবনায় থাকতে হবে।
সবচাইতে বড় ব্যাপার হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যাদের শিক্ষাব্যবস্থা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আপডেটেড, যারা সরাসরি এই টেকনোলজিক্যাল রেভুলিউশনের রিসার্চ, ইম্প্রুভমেন্ট নিয়ে কাজ করছে – তারাই যদি AI এর অভাবণীয় অগ্রগতিতে জব সেক্টরের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকে, সেখানে আমাদের মত দেশের ‘GPA 5 প্রজন্মের’ ভবিষ্যৎ আসলে কি?